ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

ভগবানের আশির্বাদ ডা. দেবী শেঠি আর চট্টগ্রামের চিকিৎসক!

জে.জাহেদ ::  দেশে প্রতি বছরই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। ভালো চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার পথে রোগীর ছুঁটাছুটি। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অনেকেই এখন দেশের বাহিরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বলতে গেলে আস্থা রাখতে পারছেন না দেশীয় চিকিৎসকের উপর।

দেশে চিকিৎসা নেওয়া যায়-এমন অসুখেও বিদেশ চলে যান তারা। এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তারাও চিকিৎসা নিতে ছুটে যান বিদেশে। সব মিলে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা কয়েক লাখেরও বেশি। নেওয়াটাও বলব স্বাভাবিক কারণ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। যেখানে ভালো কিছু উদ্ভব হবে, মানুষ লুপে নিবে এটাই স্বাভাবিক। শুধু ভারতেই গত বছর মেডিকেল ভিসা নিয়ে গেছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার বাংলাদেশি।

অনেকে মন্তব্য করেন এদেশে মান সম্মত চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে রোগীরা বাইরের দেশের হাসপাতালে চলে যাচ্ছে, এমনটি ধারণা। আবার এমনও ধারণা আমাদের দেশের ডাক্তারগণ রোগীদের সময় কম দেন, অল্প সময়ে অনেক রোগী দেখেন; অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করতে দিয়ে কমিশন বাণিজ্য করেন।

বলব না কোনটা সত্য আর মিথ্যা। তবে বলব ভিন্নচিত্রও আছে, আমার দেখা এরকম একটি ঘটনা আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। সে ঘটনার শুরুতেই বলি। অনেকে হয়তো শুনে আশ্চর্য হবেন যে, বিদেশ থেকেও আমাদের দেশে রোগী আসে। কিংবা আমাদের দেশের ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন দেখে বাইরের দেশের ডাক্তার তাঁর প্রেসক্রিপশনে কোন দাগ না লাগিয়ে, দেশের যে ডাক্তার চিকিৎসা নিয়েছিলেন, তাঁকে অনুসরণ করতে বলেন।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন ডাঃ দেবী প্রসাদ শেঠি যদি তা করেন। তাহলে আরো অবাক করা বিষয়। হা এটাই সত্য বাংলাদেশী ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখে রোগীকে তিনিও ব্যাক করে দিয়েছেন বাংলাদেশী ডাক্তারের কাছে। এমন নজিরও রয়েছে ঘটনায়।

ঘটনা বলছি। আমার এক বন্ধুর নাম মো. শাহাজাহান। বয়স ৪০ এর উপরে। ভালো ব্যবসায়ি। তবে তিনি এক সময় ধুমপান করতেন। আমরা কয়েকজন বন্ধু প্রতিদিন রাত ১০টায় একটা খোলা জায়গায় বসে আড্ডা দিতাম। প্রতিদিনের মতো সেদিনও বসে গল্প হচ্ছে। হঠাৎ বন্ধু শাহাজাহান বলে উঠে বুকে ব্যথা তার। তখন বসে থাকা সকলে তাকে বললাম হয়তো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। বাসায় গিয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমাতে। পরে জানা গেলো সে বাসায় গিয়ে পরিচিত এক ডাক্তারকে ফোন করে কিটোরোলাক ট্যাবলেট খেয়েছেন। যা ১০ টাকা দামের ব্যথার ঔষধ। কিন্তু বুকে ব্যথা কমলো না। রাতে প্রচুর ঘামও ঝরে আবার বমি ও হয়েছে বলে জানলাম..

পরের দিন বিকেল ৩টায় আমাকে কল দিয়ে শাহাজাহান বলল-পুরাতন ব্রিজঘাট যেতে। সময় মতো আমি গেলাম। দুজনে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে ফিরিঙ্গিবাজার অভয়মিত্রঘাট মসজিদ পর্যন্ত গিয়ে দেখি সে আর হাঁটতে পারছে না। আমি তাড়াতাড়ি সিএনজি নিলাম। ড্রাইভারকে বললাম ন্যাশনাল হসপিটালে যাও। সিএনজি চলছে আর আমার ঐ বন্ধুটি দেখি আমার গায়ের উপর পুরো শরীর ছেড়ে দিচ্ছে ধীর ধীরে। আমি দেখলাম সে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। ভয়ও পাচ্ছিলাম তবে আমি সাহস হারায়নি। গাড়িওয়ালাকে বল্লাম রং সাইটে দ্রুত ন্যাশনাল হসপিটালে যেতে।

কম সময়ে পৌছে গেলাম মেহেদীবাগ ন্যাশনাল হসপিটালে। জরুরী বিভাগে দেখানোর পর ইসিজি দেখে ডাক্তার হতবাক। বললেন-আরেকটু দেরিতে আসলে উনাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। রোগীকে এইচডিইউতে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার চিকিৎসা দিলেন; পুরো ৭/৮ ঘন্টা ঘুম। পরে স্বাভাবিক হলেও মুখের স্বর খুব ছোট। বুকে চাপ রয়েছে। তা দেখে আমি হসপিটালের ডাক্তারকে বল্লাম, আপনারা আমার রোগীর জন্য ডা. ইব্রাহিম চৌধুরী স্যারকে প্রাইভেটে কল দেন। উনি এসে আমার রোগীটা দেখুক আমি বিল দেবো। যথাসময়ে স্যার এসে রোগী দেখে বললেন, আজ রোগী এখানে থাকুক। আমি একটি মেডিসিন দিলাম ও একটি মেডিসিন বাদ দিলাম। এসব আজ চলবে। টেনশন করোনা। আগামীকাল যেনো ম্যাক্স হসপিটালে রোগীর এনজিওগ্রাম ও ইকো-কার্ডিলজি করি।

আমি তখন উঁকি দিয়ে দেখলাম রোগী ঘুম। এরমধ্যে খবর পেয়ে রোগীর পরিবারের সদস্যরা সবাই আসল। সবার মাঝে একটা ভয় কাজ করছে। আমার কাছে জানলো কিভাবে এ রকম হলো। আমি সব জানালাম। পরের দিন ম্যাক্স হসপিটালে রোগী কে নিয়ে গেলাম, ইকো-টেস্ট করালাম।

ডা. ইব্রাহিম চৌধুরী স্যারকে রিপোর্ট দেখালাম। স্যার বললেন, রোগীর একটু সমস্যা আছে হার্টে। এর জন্য সম্বল থাকলে একটা রিং বসাতেও পারেন। না বসালেও চলবে। তবে দু’বছর টানা ঔষধ খেতে হবে। আশাকরি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। ধুমপান করার ফলে এ সমস্যা হয়েছে।

এর কিছুদিন পর উন্নত চিকিৎসার জন্য আমার সেই বন্ধু শাহাজাহান ও মাসুদ রানা নামে আরেক বন্ধু মিলে গেলেন ভারতের দেবী শেঠি স্যারের কাছে। অল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ভারত সরকার ২০১২ সালে যাকে ‘পদ্মভূষণ’ পদকে ভূষিত করেন। ভারতের সেই প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞকে। যাকে মাদার তেরেসা ভগবানের আশির্বাদ বলেছিলেন।’

ভারতে পৌঁছে আমার ঐ বন্ধুটি নারায়ণ হেলথ হসপিটালের চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তা এই দেবী শেঠিকে দেখানোর সিরিয়াল নিলেন। তার দু’এক দিনের মধ্যে দেখা পেলেন সেই বিখ্যাত হার্ট সার্জনের। দেশে এসে বন্ধু শাহাজাহান জানালো, দেবী শেঠি তার সাথে টেনে টেনে খুব সুন্দর করে ধীর স্বরে বাংলায় কথা বলেন। তার রোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে থাকেন। বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট দেখেন। বাংলাদেশে দেখানো ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহীম চৌধুরীর প্রেসক্রিপশন ও কি কি মেডিসিন দিলেন তার খুটিনাটি দেখলেন।

কিছুক্ষণ পর আমার বন্ধুকে ডা. দেবী শেঠি বললেন, আপনার হার্টে তেমন কোন সমস্যা নেই, ধুমপানের কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে এই জায়গায়! এমন কথা বলে; দেবী শেঠির সামনে টেবিলে থাকা প্লাস্টিকের হার্টের একটি পার্ট টু পার্ট অংশ খুলে রোগীকে বুঝিয়ে দিলেন কোন জায়গায় তার সমস্যাটা। এরপর বললেন, আপনাকে বাংলাদেশের যে ডাক্তার চিকিৎসা দিয়েছেন উনি শতভাগ সঠিক চিকিৎসা দিয়েছেন। আমি কোন ঔষধ দিচ্ছি না। উনি বেটার চিকিৎসা দিয়েছেন। আপনি উনার কাছে যান। একথা শোনে তো রোগী অবাক।

এতদুর থেকে গেলেন দেবী শেঠির মতো একজন ডাক্তার কোন ঔষধ দিলেন না। বরং বাংলাদেশের ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কেমন যেনো একটা ধাক্কা খেলো রোগী। রোগীর এটেন্টডেন্স হিসেবে থাকা বাংলাদেশী যুবক মাসুদ রানাকে রোগী বলল, আসলে আমরা বিদেশে কেন আসলাম? দেশের ডাক্তারের প্রতি আমাদের কেন আস্থা কমে যাচ্ছে? বাংলাদেশের যেসব ডাক্তারের প্রতি আমরা আস্থা রাখতে পারছি না? সেই ডাক্তারদের চিকিৎসা দেখে স্বয়ং এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত হার্ট সার্জন দেবী শেঠি আস্থা রাখলেন।

এর দুদিন পর সবকিছু গুছিয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরে আসে বন্ধু শাহাজাহান। দেশে এসে দেখালেন চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল স্পেশালাইজড কেয়ার এন্ড রিসার্সের হৃদরোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহীম চৌধুরীকে। জানালেন ভারতে দেবী শেঠীকে দেখানোর আদ্যপান্ত। পরে তিনি ঔষধ দিয়েছেন তাই চলছে আজ অবধি। ২০১৫ সাল থেকে এখনো চিকিৎসা চলছে। বন্ধু শাহাজাহান এখন পুরোপুরি সুস্থ্য রয়েছেন।

এতে স্পষ্ট বুঝা যায় বিদেশ নয়, আমাদের দেশেও ভালো চিকিৎসক রয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা মনে হয়; বেশির ভাগ ডাক্তার রোগীদের সাথে ভাল ব্যবহার করছেন না। রোগীকে ভালো সময় দিচ্ছেন না! এমনকি কেউ কেউ রোগীর সমস্যার কারণ শোনতে বিরক্ত প্রকাশ করছেন। যার কারণে দেশের ডাক্তারদের উপর মানুষের আস্থা কমছে। যদিও সব ডাক্তার এক রকম নয়। আমি কথাটি ঢালাওভাবে বলছি না।

আমাদের দেশেও ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহীম চৌধুরী’র মতো ভালো মানের চিকিৎসক রয়েছেন। যারা মানবিক ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। যারা পথেঘাটে রাস্তায় যেখানে রোগী সেবা চায়, সেখানেই দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ জানায়, গত ১৫ বছরে ১০ হাজারের বেশি হৃদরোগীর এনজিওগ্রাম করেছেন তাঁরা। আমার আরেক বন্ধু আবদুর নুর বলেন, ভারত ও বাংলাদেশী ডাক্তারদের মধ্যে পার্থক্য হলো একটাই; আর সেটা হলো রোগীকে সেবা দেওয়ার ভাষাটা ভারতে রয়েছে কিন্তু আমাদের দেশে কম।’

গত বছরের ১৫ জুন চট্টগ্রাম ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল উদ্বোধনকালে বাংলাদেশে আসেন দেবী শেঠি। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘ইউরোপে মানুষের বয়স ষাট পেরিয়ে গেলে অর্থাৎ অবসরকালীন সময়ে হৃদরোগ হয়। এ সময় তারা কাজ করেন না আর ভোজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশে মানুষদের তরুণ বয়সেই হৃদরোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এর প্রধান কারণ জিনগত। এখানকার মানুষের জীবনধারা, খাদ্যাভাস, ধূমপান, ডায়াবেটিস হৃদরোগের জন্য দায়ী।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ অঞ্চলের মানুষ রোগ হওয়ার পর চিকিৎসকের কাছে যায়। এর আগে যায় না। শরীরের চেকআপ করায় না।তাদের মতে, সুস্থ থাকার সময় কেন ডাক্তারের কাছে যাবেন! কিন্তু এমন ধারণা একেবারেই সঠিক নয় জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সুস্থ থাকার সময়ও চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সবকিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখতে হবে কতটা সুস্থ রয়েছেন তিনি।’

লেখক:
সাংবাদিক ও অনলাইন এক্টিভিটিস, চট্টগ্রাম।

পাঠকের মতামত: